আনুবাদ – পার্থ মিশ্র
দুটো গ্রীষ্ম, দুটো আলাদা সময় ।
কিন্তু সেই রেশমি হাওয়া এখনো একই ভাবে আকাশ থেকে ঘুর পাক খেতে খেতে নাঙ্গা পাহাড়ের চুড়োর পাথরে ধাক্কা দিয়ে পড়ছিল।
আমি নেমে এলাম হাওয়াইআড্ডার ঢালু বেয়ে ,
টারমাকে কানাঘুষো শুনলাম সেনারা বাগান জ্বালিয়ে দিয়ে স্বর্গকে বাঁচাবে! “অপারেশন টাইগার”।
এটা আমার বাড়ি , ছাই দিয়ে ঘেরা এক আভাগা স্বর্গ ।
গোটা রাস্তায় ইটের টুকরোর ওপর দিয়ে , আর আধা সেনাদের ক্রমাগত জিগ্বাসাবাদের মধ্যে দিয়ে আমি “হারমনি” তে ঢুকলাম .
পিঠোপিঠি তিনটে বাড়ি , সবুজ ঘাসে ভরা বেশ কয়েক একর জমি দিয়ে ঘেরা তিনটে ইমারত যেখানে আমার মাকেই সবচেয়ে বেমানান ভাবে দীন মনে হত ।
একদম সামনেই একটা সেনা ছাউনির অবিরত কিন্তু অদৃশ্য দৃষ্টির মাঝখান দিয়েই আমি ফটক খুললাম,এক অবাঞ্ছিত আতিথি নিজেরই ঘরে ।
কিন্তু বাগানের মালিকে দেখছিনা তো , সে কোথায় চলে গেল ?
আমার দিদিমার ঘরে তালা, যেখানে কিনা তাঁর দুই ছেলে শহিদ হয়েছিল। আসলে তারপর থেকে সেখানে না কোন আয়না আছে , না আছে কারো প্রতিবিম্ব
জানলার নীচে ওদের বিছানায় বুনো গোলাপের ঝাড় এখনো দম আটকে শুয়ে আছে।
আচ্ছা মালিকে কি ওরা সত্যিই মেরে ফেলেছে ?
আর ডাক হরকরাকে?
বারান্দাতে খোল নলচে বেরিয়ে পড়া পুরনো সুগন্ধি টেবিলের ড্রয়ার হাতড়াতেই বেরিয়ে এলো কিছু সোদাঁ গন্ধ চিঠির টুকরো ,
একটা বাবাকে লেখা গত শরতের সভাতে উপস্থিত থাকতে,
আরেকটা এক বিয়ের নিমন্ত্রন ।
কোন কারণে আমার প্রথম চাবি ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল ভেতর ঘরের আর আমি এক নৈঃশব্দ্যের মধ্যে তৎক্ষণাৎ ঢুকে পডলাম ,
আলোটাও দেখলাম বিনা বাধায় জ্বলে উঠল।
ঠিক যেখানে মা ছেড়ে এসেছিল সেই ওয়ালনাট টেবিলে অদ্ভুত ভাবে জামওয়ার শালে মোড়া কোরান খানি এখনো রয়েছে ,
আর তার পেছনে ফায়ার প্লেসের ওপরেই লেখাটা একইভাবে জ্বলজ্বল করছে,
“ঈশ্বর তোমার সাথে তো জয়ও তোমার সামনে”
মাকড়সার জালের মধ্যে দিয়ে বাক্য টুকু যেন আরো বেশী স্পষ্ট।
আমি মূক ফোনটাকে তুলি , নির্বাসিত কিছু সংখ্যা মুছে যাচ্ছে যন্ত্রাংশ থেকে, বিছিন্ন আর বিস্মৃত কিছু স্বর ভাষাহীন ভাবে যেন আলতো ছুয়ে থাকে তাতে।
তারপরেই হটাতই বাঙময় হয়ে ওঠে সে , রফি সাহেবের একটা গান গুনুগুনিয়ে ওঠে, কোন এক যুদ্ধের গান ,
আর আমি আরও ধীরে আরও ধীরে হেঁটে চলি সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে
এই ভাবেই আমার মায়ের থেকে দূরে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যেতে থাকি।
গান শেষ হল , ভাষ্যকার বলে উঠল , “This is all India Radio, Amritsar ”
আমি ফোনটা রিসিভারে রাখি ।
দোতালায় জানালার কাচেও আয়না লাগান আছে , আমি ঝাঁপালে আমার নিজের কোলেতেই এসে পড়ব আবার,
আর সেই জানালার ভিতর দিয়ে আমার চাহনি কে দূরের পাহাড়গুলো কোন রক্ত না ঝরিয়ে বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছে ।
বইয়ের তাকে ‘রিতশোস’, ‘রাইল্কে ‘, ‘চাভাফি’, ‘লোরকা’ , ‘ইকবাল’, ‘আমিসি’,আর ‘পাজ’ এই সব কবিদের সাথে গা লাগিয়ে আমার বাবামায়ের বিয়ের ছবি এখনো একই ভাবে এতো ঝকঝকে আর সজীব !
অথচ মা আমার , সাদা কালো ফ্রেমে এক অষ্টাদশী , যখন প্রথম এই “হারমনি” তে এসেছিলেন , সারা বাড়ি কেঁপে উঠেছিল বেসামাল হয়ে তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যে ,
তিনি যেমনি দীন ছিলেন তেমনই দুর্দান্ত সুন্দরও ছিলেন ।
সেই কম্পন , সেই গোটা বাড়ি ময় উত্তেজনা এখন আমি আবার পাচ্ছি,
আর এখন এই সেই বাড়িটাই আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে সামলাতে ,
সেই শূন্য বাড়িটাই,
আর সেই শূন্যতা থেকে গুমরে ওঠা কান্নাই
এখন বেসামাল আমাকে সামলাচ্ছে ।