তুমি যখন এই কবিতা লিখছিলে তখনো সাব্রা সাতিলার নৃশংসতার দুবছর বাকি ছিল ,
বেইরুটের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে খোলা আকাশ তখন ভাগ করে নিয়েছে ইসরায়েলি বিমান আর খবরের কাগজওালারা,
তুমি মূক সাক্ষী ছিলে সেই পাথর ছোঁড়ার ,
তোমার শহর থেকে অনেক দূরে ,
পাকিস্তানের উদ্যত কৃপাণ থেকে অনেক দূরে,
নিজের হাত ও কলম দুটোকেই কোনমতে বাঁচিয়ে
।
অথচ এই উপমহাদেশ তোমাকে ছাড়তে চায়নি
কোনদিনও,
গালিবের কবিতা , মৃত কবিদের সান্ধ্যগীত ,
সব সময় তোমার আশেপাশে থেকেছে সেই
নির্বাসনে।
১৮৫৭ সালের যে ঝোড় হাওয়া দিল্লির
কোন এক সকালকে শেষ রাতের ঘুম থেকে টেনে তুলেছিল
সারিসারি সিপাহীর ঝুলন্ত মৃতদেহ দেখাবে বলে,
যখন গালিবের সাথে তোমার কথোপকথন আরও সোচ্চার হচ্ছিল ,
যখন একে একে বিষণ্ণ কবিরা তুনিশিয়া , বেইরুট, লন্ডন বা মস্কোতে
আড়ালে আবডালে নিরব শোক করছিলো
তোমার কবিতা তখন আরও বেশি বাঙময়
।
এক ভঙ্গুর সময় কে , এক বিষণ্ণ সময়কে ধরে রাখা তোমার শব্দগুলো,
তখন চোখ বেয়ে ঝরে পড়া রক্তের স্রোতের সাথে ছড়িয়ে পড়ছিল ওই সব শাপগ্রস্ত আর যুদ্ধ বিদ্ধস্ত শহরের অলি গলিতে।
২
সেই ছোট বেলা থেকেই বাবা তোমার কবিতাকে চেনাতে চেয়েছে বারবার,
আমরা চিনতে চাইনি।
তোমার কবিতা বন্ধু , নারী ,নাকি
নিষ্ঠুর
প্রেমিক নাকি ঈশ্বর , তাতে সেই ছোট্ট শাহিদের কিই বা যেত আসত।
যতই তোমার কবিতার ঠোঁট রাঙ্গিয়েছ
, রুপোলি হাত দিয়েছ,
বিষণ্ণ প্রেমিদের দিয়ে তার জন্যে
রাত জাগিয়েছো ,
তবু আমরা তখনো তোমার কবিতা , তোমার
বিপ্লবকে কোন দিন চাক্ষুষ করলাম কই ?
আর সত্যি যেদিন তাকে প্রথম দেখলাম
,
ততক্ষনে তোমার ভাষাটাই চলে গেছে
, গানের আর সুরের দখলে।
বেগম আখতার বুনে চলেছেন তার রাগ
ও সুরে তোমার শব্দ গুলো নিয়ে এক আশ্চর্য মায়াজাল,
আর সেখানে তারা যেন আরও,বেশি ধারাল,
আরও বেশি উদ্যত হয়ে উঠেছে
ভালোবাসার আর কারাগারের কথা একই
সাথে বলবে বলে।
সেই আমার প্রথম হাতের এতদিনের শৈশবের
মুঠো খোলা , আর হস্তরেখায় শুধু ই রাত্রির হিজিবিজি লেখা দেখা।
৩
তারপর…
তারপর যখন তোমার সম্মতি পেলাম তোমাকে
আমার মত করে পড়ব বলে,
যখন প্রস্তর ফলকের দিকে চাইলাম , তোমাকে পড়ব বলে ,
কারাগারের গুমোট দেয়ালে ,
টুকরো টুকরো খামে ,
যখন আমি তোমার কবিতাকে হন্যে হয়ে খুজে বেড়াচ্ছি ,
তুমি তখনো ছিলে আমদেরই রক্তের মধ্যে , উষ্ণ , বহমান আর ঘোর রক্তিম,
আমারি শরীরে তারা ছিল অন্তরীন ,আমার স্বেচ্ছা নির্বাসনে
আমারই মত আরেক কয়েদী হয়ে।
তখনই , ঠিক তখনই তোমার মৃত্যু সংবাদ এল সেই উপ মাহাদেশ থেকে।
তখন সেখানে তোমার ভাষায় আর কেউ কথা
বলত না।
যেখান থেকে ঠিক কুড়ি দিন আগে তুমি
জানিয়েছিলে
বেইরুট থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তোমার
তো ঠিকানা শুধু কবিতায় ,শব্দে আর স্বগতোক্তিতে।
বন্ধ দরজার পেছনে সব মোমবাতি গুলো
তুমি নিবিয়ে দিলে ,
একেক করে সব সুরাপাত্র গুলো ভেঙ্গে
ফেললে ,
যদিও তুমি জানতে কেউ ফিরে আসবেনা , কেউ ফিরে আসেনা
কখনো, তবু ফঈজ
তুমি তো তখনো অপেক্ষায় ছিলে,
সেই ঈশ্বর , নারী, আর বন্ধুটির জন্যে
যার নাম দিয়েছিলে তুমি বিপ্লব নাকি
অভ্যুথান ।
আর আমি শুনতে পাচ্ছিলাম
তোমার অপেক্ষার মধ্যে কড়া নাড়ছিল
সেই সব কস্তূরী গন্ধের আশাগুলো , কিছু বিক্ষুব্ধ মুখশের আড়ালে।